শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৯

এক অভাগিনীর গল্প শুনি


মা-বাবার প্রথম সন্তান হয়ে দুনিয়ায় আসা শ্যাম বর্ণের মেয়েটির শৈশব, কৈশোর কাটে নানা গঞ্জনায়। যৌবনে পা দিতে দিতেই দেশে যুদ্ধ বেধে যায়। সে এক ভয়ানক যুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। পাক হানাদের কু-দৃষ্টি এড়াতে ঘরের বড় বড় সিন্ধুকই ছিলো তার লুকানোর একমাত্র জায়গা। গায়ের রঙের কারণে যখন আইবুড়ো হওয়ার উপক্রম, তখন তাকে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে পাত্রস্থ করা হয়। মেয়েটি ভাবলো এবার বুঝি একটু শান্তি পাওয়া যাবে। শান্তির বার্তা নিয়ে তার কোল জুড়ে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান এলো।

কিন্তু বিধিবাম, জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই পরীসদৃশ কন্যা সন্তানটি এক অজানা রোগে মারা যায়। বছর দুই ঘুরে আবারো ঘর আলোকিত করে একটি পুত্র সন্তানের আগমন হয়। কিন্তু এবারও তার কপাল ভিজেনি। কপাল পোড়া হলে যায় হয় আর কি! তিনমাসের মাথায় এই সন্তানটিও পরোপারে পাড়ি জমায়। এভাবে দুইটি, তিনটি নয়, একে একে সে নয়টি সন্তানের জন্ম দেয়। শুনে অবাক লাগবে, কিন্তু এটাই সত্যি যে, তার নয়টি সন্তানই জন্মের কিছুদিন পর মৃত্যু পথের যাত্রী হয়। বয়সের ভারের সাথে সাথে দশমাস দশদিন সন্তান গর্বে ধারণ করে জন্মের কিছুদিন পরই সে সন্তান কে হারানো কারো জন্যই সহজ ব্যাপার নয়। তার অবস্থাটা কেমন ছিলো, তা কেবলমাত্র দু'চোখ বন্ধ করে একটু ভাবলে খানিকটা হলেও অনুধাবন করা যেতে পারে।

তবুও তিনি হাল ছাড়ার পাত্রী নন। আবারও একটি সন্তানের আশায় রাত দিন আল্লাহর কাছে রোনাজারি করে, মান্নত করে, রোজা রাখে। আল্লাহ তাকে খালি হাতে ফিরায়নি। আল্লাহ আবারও তাকে একটি পুত্র সন্তান দান করেন। এবার সন্তান জন্মের পর পরই দেশের যত বড় বড় হেকিম, কবিরাজ, ডাক্তার আছেন, সবার দরবারে দরবারে ঘুরেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তার দশতম সন্তানটি বেঁচে যায়। আল্লাহকে হাজার ধন্যবাদ দিয়ে নতুন স্বপ্নে ছেলে, স্বামী নিয়ে সুখে বসবাস করতে থাকেন।

দুঃখ যার নিত্যসঙ্গী তাকে কষ্টের মাকড়সা এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিবে? তা কি করে হয়! ছেলের বয়স যখন ৭ বছর তখন স্বামীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হামলায় ভিটেমাটি ছাড়তে হয় (বাড়িঘর জালিয়ে দেয় প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীবাহিনী)। আশ্রয় মিলে দূরের শহরে তার পিত্রালয়ে। নতুন বাসা বাঁধেন সেখানে। কিন্তু অভাগিনীর কপালে আবার নেমে আসে দুর্ভোগ। নতুন ঠিকানায় যাওয়ার বছর খানেক পর তার স্বামী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দুনিয়া ত্যাগ করে। স্বামীর বাসস্থান হারা, আশ্রয়ের জায়গা প্রাণের স্বামী বিয়োগে বেচারি যেন পুত্র সন্তান নিয়ে অকুল সাগরে ভাসছেন। ঠিক কি করবেন এখন, কোন দিশা না পাচ্ছিলেন না।

অকুল দরিয়ায় ভেসেও সে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার মনস্থির করে। স্বামীর ইচ্ছা অনুযায়ী ছেলেকে শিক্ষিত করতে হবে। মানুষের মতো মানুষ বানাতে হবে। কিন্তু কিভাবে সে যোগান দিবে? দু'চোখে অন্ধকার দেখেন। সবাই পরামর্শ দেন আবার বিয়ে করার জন্য।

নাহ, বিয়ে সে করবে না। সে তার কলিজার টুকরা ছেলেকে বুকে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার পণ করেন। বিয়ে তো প্রশ্নই আসে না। জীবন চলার পথ কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে। তবুও এগিয়ে যায় তার কষ্ট জর্জরিত হেলে পড়া জীবন। বোনের এমন কষ্ট তার ভাইয়ের সহ্য হয়নি। তাই তিনি ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়। ভাগিনা ও বোনের দায়িত্ব নেন। কিছুটা হলেও অভাগীর কষ্ট লাঘব হয়।

দিনে দিনে ছোট্ট ছেলেটি বড় হতে থাকে। সেও তার দায়িত্ব কর্তব্য বুঝতে শিখে। ভালো ফলাফল করে বিদ্যালয় থেকে পুরষ্কার পাওয়ার পাশাপাশি বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ পায়। দু, তিনটা টিউশনিও পায়। এতোকিছুর পরেও ছেলেটা ডানপিটে স্বভাবেরই হয়। তবে নিজের দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকে। আর তাই অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে নিজের বাসস্থান, ভিটেমাটিতে পা রাখতে সক্ষম হয়।

মায়ের মতো সন্তানের পথচলাও দিনে দিনে দুর্গম হয়। বহু চড়াই উৎরাই পার হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলে শুধু অভাগিনীর দোয়া আর ভালোবাসার বদৌলতে। আস্তে আস্তে অভাগিনীর দিন ফিরে আসতে শুরু করলো। বয়সটা তার বেজায় বেড়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে রোগ-শোকের সাথে পাল্লা দিয়ে শরীর কুলিয়ে উঠতে পারে না।  

তবুও একদিন সোনালী ভোর দেখে বিদায় নিতে পারবে সে স্বপ্ন দেখে দিন কাটে তার। গল্পের জনমদুখিনী মানুষটিই আর কেউ নন, তিনি আমার জন্মদাত্রী মা। আমিই সে, তার দশতম নাড়ী ছেঁড়া ধন।
Share:

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচিত পোস্ট

এক অভাগিনীর গল্প শুনি

মা-বাবার প্রথম সন্তান হয়ে দুনিয়ায় আসা শ্যাম বর্ণের মেয়েটির শৈশব, কৈশোর কাটে নানা গঞ্জনায়। যৌবনে পা দিতে দিতেই দেশে যুদ্ধ বেধে যায়। সে এ...

সংগ্রহশালা

আমাকে লিখুন

নাম

ইমেল *

বার্তা *