বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২০

আরেকটি বাংলাদেশের সমান অপার সম্ভাবনার সমুদ্রসীমা ও আমাদের করণীয়




এটা জানা কথা যে, পৃথিবীর তিন ভাগ জল, একভাগ স্থল। পৃথিবীর নব্বই ভাগ বাণিজ্যিক কার্যক্রমও জলপথে সংগঠিত হয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতি বহুবিধভাবে অবদান রেখে চলেছে। বছরব্যপী ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। বিশ্বের ৪শ ৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের যোগান দিচ্ছে সামুদ্রকি মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানী তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে।
এই বাস্তবতায় পৃথিবীর দেশসমূহ তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত চাহিদা মেটাতে তাকিয়ে আছে সমুদ্রবক্ষে সঞ্চিত সম্পদের দিকে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাবার যোগান দিতে তখন সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে সবাইকে। সেই লক্ষে জাতিসংঘ ২০১৫ সাল পরবর্তী যে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে তার মূলকথাই হচ্চে ব্লু ইকোনোমি। আর ব্লু ইকোনোমির মূল ভিত্তি হচ্ছে টেকসই সমুদ্র নীতিমালা।
আন্তর্জাতিকভাবে সমুদ্রের গুরুত্ব বা সমুদ্র নীতিমালা নিয়ে বিস্তারিত আরেকদিন আলাপ করবো, আজ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা এবং সম্ভাবনা ও করণীয় নিয়ে একটু আলাপ করি।
২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে আর ২০১৪তে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিস্পত্তি হওয়ার পর বাংলাদেশের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশী সামুদ্রিক এলাকা, ২০০ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল সমান ১.৮৫ কিলোমিটার) একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (Exclusive Economic Zone) ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে (Continental Shelf) সব ধরনের প্রাণীজ-অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। যার আয়তন প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান।
এই সুবিশাল জলরাশির ভেতরেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের সমুদ্র বা নীল অর্থনীতির এক অপার সম্ভাবনা। কারণ সমুদ্র উপকূল পরিবেষ্টিত পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে পাল্টে দিয়েছে তাদের দেশের অর্থনীতি।
উদাহরণসরূপ ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার কথা বলা যায়, ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্র নির্ভর। সাম্প্রতিকসময়ে দেশটি এমনকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যে, তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা গেলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান জাতীয় বাজেটের দশগুণ হবে। (ইন্দোনেশিয়া একটি দ্বীপ বেষ্টিত রাষ্ট্র বা Archipelagic State, এতে ১৭ হাজার ৫০৮টি দ্বীপ রয়েছে)।
অপরদিকে অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে থাকে। আর ২০২৫ সাল নাগাদ এই আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারে। দ্যা জাকার্তা পোষ্ট এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে দ্যা লমবক ব্লু ইকোনোমি বাস্তবায়ন কর্মসূচী ৭৭ হাজার ৭০০ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করার পাশাপাশি প্রতিবছর ১১৪.৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করবে।
আবার ফিরে আসি আমাদের সমুদ্রসীমার আলাপে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কি পরিমাণ সম্পদ ছড়িয়ে আছে তা আজও বাংলাদেশের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে যে তেল-গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে ভূ-তাত্ত্বিকরা বলছেন প্রবল সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশ অংশেও তা পাবার।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র সম্পদ গবেষকরা বহুকাল আগে থেকেই বঙ্গোপসাগরকে বিভিন্ন ধরনের সম্পদের খনি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যে খনিজ সম্পদ রয়েছে তা পৃথিবীর আর কোনও সাগর, উপসাগরে নেই বলেও ধারণা অনেকের। আরো বহু বছর আগে মণি, মুক্তা, সোনা, রূপা, তামা, প্রবালসহ বিভিন্ন ধরনের মহামূল্যবান ধনরত্ন এখানে রয়েছে ধারণা করে, ভারতবর্ষের পৌরাণিকে বঙ্গোপসাগরের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রত্নাকাগার’।
যদিও আমরা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো গবেষণা করে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কি পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে কিংবা তা সাগরের ঠিক কোন জায়গায় আছে তা চিহ্নিত করতে পারিনি, তথাপিও কিছু কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে, তেল, গ্যাস, চুনাপাথর, ১৭ ধরনের খনিজ বালি (যার মধ্যে রয়েছে মোনাজাইট নামক এক অতিমূল্যবান পদার্থ। এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ও পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে ব্যবহৃত হয়), সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম এবং আকরিক নামক দুর্লভ ধাতুসহ সহস্র খনিজসম্পদ।
এছাড়াও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় আছে ৪টি বড় মৎস্যক্ষেত্র। যেখানে প্রায় ৪৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির তিমি, ১০ প্রজাতির ডলফিন, প্রায় ২০০ প্রজাতির সি উইড (এক ধরনের সামুদ্রিক ঘাস) রয়েছে বলেও গবেষকরা মনে করেন। এই ঘাস ও আগাছা চীন, জাপান ও ইউরোপীয়দের কাছে সুখাদ্য হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ব‍র্তমানে মাছ ধরতে বাংলাদেশের জেলেরা দেশী নৌযান নিয়ে মাত্র ২০ থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশের জেলেদের কাছে সমুদ্রসীমার বড় একটা অংশই অজানা। ৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরে যাবার মতো মাছ ধরার কোনো নৌযানই নেই বাংলাদেশের। এই সমস্যার সমাধান করা নিশ্চয়ই কঠিন কিছু নয়। কিন্তু কে করবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সম্পদ বাংলাদেশকে যেমন দিতে পারে আগামী দিনের জ্বালানী নিরাপত্তা, তেমনি বদলে দিতে পারে অর্থনীতির সামগ্রিক চেহারা। সাগরে প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, জিডিপিকে দুই অঙ্কের ঘরে নিতে পারে খুব সহজেই।
এমনকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সামুদ্রিক খাবার ও পুষ্টি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাও সম্ভব। অন্যদিকে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে সমুদ্র নির্ভর অর্থনীতির বদৌলতে। এগুলো কিন্তু কথার কথা নয় কিংবা পরীক্ষার খাতায় লিখার জন্য কোনো মুখস্ত বিদ্যাও নয়। বাস্তব সত্য।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলংকা ও মিয়ানমার ব্লু ইকোনমি নিয়ে কাজ করছে বহু আগে থেকেই। কিন্তু আমরা এই ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে, 'সমুদ্র বিজয়' করেছি বলে বিলবোর্ডে আর মিডিয়াপাড়ায় উল্লাস করার ৫ বছর পার হলেও এখনো উল্লেখ করার মতো কিছুই করতে পারিনি।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য সমুদ্র সম্পদ আহরণ কিন্তু সহজ কোনও বিষয় নয়। সমুদ্রে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, খনন, আহরণ সবই প্রযুক্তিগত বিষয়। তাই আজ চাইলে কালই যে সমুদ্রসম্পদ আহরণ শুরু করা যাবে তা কিন্তু নয়। এজন্য প্রয়োজন দক্ষ পরিকল্পনা। কিন্তু আমাদের তো এই দক্ষ পরিকল্পনারই যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে।
বহুল আকাঙ্ক্ষিত 'সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ' ২০১৪ সালে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, আজও তা আলোর মুখ দেখেনি। আমাদের সমুদ্রের যতটা জানা, তার চেয়ে বেশী অজানা। এই জরিপটি হলে অন্তত আমাদেরকে ধারণা আর অনুমান করে কথা বলতে হতো না। বিদেশিদেরকে জরিপের ফলাফল দেখিয়ে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা যেতো।
তবে আশার কথা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংক্রান্ত গবেষণা ও নিয়মিত অনুষদ খোলা হয়েছে। চট্ট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে, ২০১৩ সালে মেরিটাইম নিয়ে স্বতন্ত্র একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়েছে, যা বাংলাদেশ ১ম, দক্ষিণ এশিয়াতে ৩য় এবং বিশ্ব ১২তম মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৪ সালে ব্লু ইকোনোমি সেল গঠন হয়েছে। এসবই ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ।
উপরোক্ত একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি দ্রুত আরও কিছু কাজ করা খুব জরুরী বলে মনে করি।
১. যত দ্রুত সম্ভব স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
২. সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপটি দ্রুত সম্পন্ন করা। প্রয়োজনে বিদেশী দক্ষ সংস্থার সহযোগিতা নেয়া।
৩. সমুদ্র অ‍র্থনীতিকে যারা সফলভাবে কাজে লাগাচ্ছে, যেমন ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার এ সংক্রান্ত গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করে একটি সমুদ্র নীতিমালা প্রণয়ণ করা।
৪. দেশের বাইরে যে সকল বাংলাদেশিরা এই খাতে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও কাজে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন তাদের সহযোগিতা নেয়া এবং তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে কাজে লাগানো।
৫. এই খাতে পর্যাপ্ত বাজেট দেয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত একটি শক্তিশালী অথোরিটি (Sea and Maritime Authority) গড়ে তোলা।
৬. সমুদ্র বিজ্ঞান ও সমুদ্র আইনের বিকাশে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ সংক্রান্ত বিভাগ খোলা (Maritime Law এবং Marine Science) ও আলাদা গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করা।
৭. সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আয়োজনসহ বিভিন্নভাবে বিদেশি ও দেশী বিনিয়োগকারিদের সমুদ্রে বিনিয়োগে আগ্রহ তৈরি করা।

মনে রাখবেন, পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে, যাদের সমুদ্রসীমা নেই, তবুও তারা সামুদ্রিক অর্থনীতিতে শীর্ষে অবস্থান করছে। স্রষ্টার অপার করুণায় আমরা পেয়েছি অপার সম্ভাবনার সমুদ্রসীমা। এই অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা হতে পারি স্বাবলম্বী ও ধনী রাষ্ট্র।

Share:

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচিত পোস্ট

এক অভাগিনীর গল্প শুনি

মা-বাবার প্রথম সন্তান হয়ে দুনিয়ায় আসা শ্যাম বর্ণের মেয়েটির শৈশব, কৈশোর কাটে নানা গঞ্জনায়। যৌবনে পা দিতে দিতেই দেশে যুদ্ধ বেধে যায়। সে এ...

সংগ্রহশালা

আমাকে লিখুন

নাম

ইমেল *

বার্তা *